কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি - বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে
কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি অথবা কোন জাতের ছাগল সবচেয়ে ভালো, যদি জানতে চান তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এখন অনেকেই গরু-ছাগল পালন করে সংসারে বাড়তি আয় করছেন।
বিশেষ করে ছাগল পালন তুলনামূলকভাবে সহজ এবং কম পুঁজিতে শুরু করা যায় বলেই দিন দিন এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি? এই প্রশ্নের উত্তর জানলে কেউ নতুন করে ছাগল পালনের দিকে এগোতে সাহস পায়, আবার কেউ তার বর্তমান খামারে উন্নত জাতের ছাগল আনতে চায়।
আরো পড়ুন : কোন জাতের হাঁস পালন বেশি লাভজনক
আমার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় প্রায় ছয় বছর ধরে ছাগল পালন করছেন। তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এবং নিজে কিছু গবেষণা করে আজ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি এবং কোন জাতগুলোর খরচ-সাপেক্ষে আয়ের হার বেশি।
ছাগলের জাত কত প্রকার
ছাগলের জাত মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়
1. দেশি জাত
2. বিদেশি বা সংকর জাত
আরো পড়ুন : কোন জাতের ছাগল বেশি বাচ্চা দেয়
দেশি জাত যেমন কালো, সাদা বা খয়েরি দেশি ছাগল। এরা রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী হলেও দুধ বা মাংসের উৎপাদন তেমন বেশি নয়। বিদেশি জাতের মধ্যে রয়েছে যমুনাপাড়ি, বিটল, সানোয়েন, তোগেনবার্গ, নুবিয়ান ইত্যাদি। এই জাতগুলো উন্নত খাদ্য ও পরিবেশ পেলে অনেক বেশি উৎপাদন দিতে সক্ষম।
বিটল জাত লাভজনক মাংস উৎপাদনে সেরা
অনেক খামারির মতে, কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি প্রশ্নের সবচেয়ে জনপ্রিয় উত্তর হচ্ছে বিটল জাত। এই ছাগল দেখতে বেশ আকর্ষণীয়, দ্রুত ওজন বৃদ্ধি পায় এবং বাজারে এর মাংসের চাহিদাও অনেক। বিটল জাতের একটি পুরুষ ছাগল এক বছরে ৩৫-৪০ কেজি ওজনের হয়ে যায়, যা বিক্রির সময় বেশ ভালো দাম পাওয়া যায়।
যমুনাপাড়ি দুধ ও মাংস দুদিকেই সমানভাবে লাভ
যমুনাপাড়ি ছাগল দেখতে লম্বা গড়নের, কানের অংশ ঝুলে থাকে এবং মেজাজ কিছুটা শান্ত প্রকৃতির।
এই জাতের মাদি ছাগল একবারে ২-৩টি ছানা দেয় এবং বছরে ১.৫-২ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয় প্রতিদিন।
তাই দুধ এবং ছানার আয় মিলিয়ে অনেক বেশি লাভ করা যায়। এই কারণেই অনেকে বলেন, কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি যমুনাপাড়ি অন্যতম উত্তম উত্তর।
- সানোয়েন দুধ উৎপাদনে দুর্দান্ত
যারা শুধু দুধের জন্য ছাগল পালন করতে চান, তাদের জন্য সানোয়েন জাত আদর্শ। এই জাতের ছাগল দিনে প্রায় ২-৩ লিটার দুধ দিতে পারে। তবে এই জাতটি একটু সংবেদনশীল এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম, তাই সঠিক ব্যবস্থাপনায় রাখতে হয়।
আরো পড়ুন : কালো থেকে ফর্সা হওয়ার উপায়
- তোগেনবার্গ
উন্নত দেশে জনপ্রিয় হলেও আমাদের পরিবেশে মানিয়ে নিতে হয় সময় এই জাতটি ইউরোপ ও আমেরিকায় অত্যন্ত জনপ্রিয়। দুধ উৎপাদনে সানোয়েনের কাছাকাছি হলেও এদের খরচ বেশি এবং খামারে আলাদা পরিচর্যা দরকার হয়। তবে যারা খামার ব্যবসায় ভালোভাবে বিনিয়োগ করতে রাজি, তাদের জন্য এটি লাভজনক হতে পারে।
দেশি জাতের ছাগল কম খরচে ধীরে ধীরে লাভ
অনেকেই ভাবেন, শুধু বিদেশি জাত হলেই লাভ হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং সাধারণ ব্যবস্থাপনায় দেশি জাতের ছাগলও ভালোভাবে পালা যায়। যাদের মূলধন কম, ছোট পরিসরে শুরু করতে চান, তারা দেশি জাতের মধ্যেই ভালো ফল পেতে পারেন।
তবে এখানে প্রশ্ন থাকে, কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি তখন অবশ্যই তুলনায় বিদেশি জাতগুলো একটু এগিয়ে থাকে।
ছাগল পালনে খরচ ও আয়ের তুলনামূলক হিসাব
অনেকেই ভাবেন ছাগল পালন মানেই শুধু খাওয়ানো আর বিক্রি করা। কিন্তু আসলে এর পেছনে কিছু গাণিতিক হিসাব-নিকাশ আছে। আমরা যদি আগে থেকেই একটু হিসাব করে নেই, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবো কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি এবং কোন খরচ কোথায় কমানো যায়।
বিটল জাতের ছাগল লাভের হিসাব
- খরচ (মাসিক)
- প্রতিদিন খাবার: ৩০ টাকা × ৩০ দিন = ৯০০ টাকা
- চিকিৎসা ও টিকা: মাসে আনুমানিক ১০০-১৫০ টাকা
- অন্যান্য (ঘর-বাড়ি পরিষ্কার, লবণ, খড় ইত্যাদি): ২০০ টাকা
- মোট মাসিক খরচ: ১২০০-১২৫০ টাকা
- আয় (১ বছর)
- ১টি বিটল ছাগল ১২ মাসে ৩৫-৪০ কেজি হয়। প্রতি কেজি ৬০০ টাকা ধরলে
- ৩৫ কেজি × ৬০০ টাকা = ২১,০০০ টাকা
এছাড়া, মাদি ছাগল হলে বছরে ২-৩টি ছানা বিক্রি করতে পারবেন। বার্ষিক লাভ: ২১,০০০ – (১২৫০ × ১২) = ৫,০০০-৬,০০০ টাকা (একটি ছাগল থেকে)
যমুনাপাড়ি জাত লাভের হিসাব
- খরচ (মাসিক):
- প্রতিদিন খাবার: ২৫ টাকা × ৩০ দিন = ৭৫০ টাকা
- চিকিৎসা ও টিকা: ১০০-১৫০ টাকা
- অন্যান্য খরচ: ১৫০ টাকা
- মোট মাসিক খরচ: ১০০০ টাকা
- আয় (১ বছর)
১টি যমুনাপাড়ি ছাগল ১২ মাসে ৩০-৩৫ কেজি হয়। প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা ধরলে:
৩০ কেজি × ৫৫০ টাকা = ১৬,৫০০ টাকা
মাদি হলে বছরে গড়ে ৪-৫টি ছানা বিক্রি (প্রতি ছানা ৪,০০০-৫,০০০ টাকা)
ছানা থেকে আয়: ৪ × ৪,০০০ = ১৬,০০০ টাকা
বার্ষিক মোট আয়: ১৬,৫০০ + ১৬,০০০ = ৩২,৫০০ টাকা
বার্ষিক লাভ: ৩২,৫০০ – (১০০০ × ১২) = ২০,৫০০ টাকা
দেশি জাত লাভের হিসাব
- খরচ (মাসিক)
- প্রতিদিন খাবার: ১৫ টাকা × ৩০ দিন = ৪৫০ টাকা
- চিকিৎসা ও টিকা: ৫০-১০০ টাকা
- অন্যান্য খরচ: ১০০ টাকা
- মোট মাসিক খরচ: ৬৫০ টাকা
- আয় (১ বছর)
১টি দেশি ছাগল ১২ মাসে ২০-২৫ কেজি হয়। প্রতি কেজি ৫০০ টাকা ধরলে:
২০ কেজি × ৫০০ টাকা = ১০,০০০ টাকা
বছরে ১-২টি ছানা বিক্রি (প্রতি ছানা ২,৫০০-৩,০০০ টাকা)
ছানা থেকে আয়: ২ × ২,৫০০ = ৫,০০০ টাকা
আরো পড়ুন : কি খেলে বেশি মিলন করা যায়
বার্ষিক মোট আয়: ১০,০০০ + ৫,০০০ = ১৫,০০০ টাকা
বার্ষিক লাভ: ১৫,০০০ – (৬৫০ × ১২) = ৭,২০০ টাকা
এই তুলনা দেখে বোঝা যায়, কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আপনার লক্ষ্য, খরচ সামর্থ্য এবং ব্যবস্থাপনার ওপর।
বাজার চাহিদাও বড় একটি বিষয়
অনেক সময় ভালো জাতের ছাগল পাললেও বাজারে যদি সে জাতের চাহিদা না থাকে, তাহলে লাভ ঠিকমতো হয় না। তাই আপনি যেই অঞ্চলেই খামার করুন, আগে স্থানীয় বাজারে খোঁজ নিন কী জাতের ছাগল বেশি বিক্রি হয়, কোনটার দাম ভালো, কিংবা কোন জাতের মাংস বা দুধে চাহিদা বেশি।
এখানে আবারও উঠে আসে সেই প্রশ্ন কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি? উত্তর হবে আপনার স্থানীয় বাজার এবং ব্যবস্থাপনা অনুসারে সেই জাত যেটির বিক্রি সবচেয়ে বেশি ও খরচ কম।
নতুনদের জন্য পরামর্শ
যারা একেবারে নতুন, তারা সরাসরি বিদেশি জাত দিয়ে শুরু না করে দেশি জাতের ২-৩টি মাদি ছাগল এবং একটি পুরুষ ছাগল দিয়ে শুরু করুন। ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা বাড়লে বিটল বা যমুনাপাড়ি জাত আনতে পারেন। সঠিক পরিচর্যা, নিয়মিত টিকা ও পরিষ্কার পরিবেশ এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে যে কোনো জাতের ছাগল থেকেই লাভবান হওয়া সম্ভব।
তবে শেষ কথাটি আবারও বলি কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি এই প্রশ্নের একক উত্তর নেই, বরং সেটা নির্ভর করে আপনার পরিবেশ, সময়, বাজেট এবং অভিজ্ঞতার ওপর।
শেষ কথা: লাভ চাইলে বুঝে কাজ করতে হবে
একটি ভালো খামার গড়তে হলে শুধু জাত বাছাই করলেই হবে না পরিচর্যা, খাদ্য, চিকিৎসা, সময় এবং শ্রম সবকিছুর সমন্বয় প্রয়োজন। তবে যেহেতু আমরা বাস্তবতার ভিত্তিতে বলছি কোন জাতের ছাগল পালনে লাভ বেশি, তাহলে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর জাত হিসেবে বিটল ও যমুনাপাড়ি ই শীর্ষে রয়েছে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url